ভিতরগড় | Bhitargarh 22/01/2022


PC:


বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের লেখাতে প্রায় প্রায়ই এই কথাটি উঠে আসে যে বাংলার পরদে পরদে ইতিহাস লুকানো রয়েছে। বাংলা আকাশ বাতাশ প্রকৃতি সবই রহস্যে ঘেরা। এই অপরুপ বাংলার আরেক বিস্ময় হল মধ্যযুগের প্রাচীন দুর্গনগরী ভিতরগড় (Bhitargarh Durgo) যা কিনা পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত। পুরাতন হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশীয় সমতল ভূমিতে তরাই অঞ্চলে অবস্থিত ভিতরগড়ের উপরিভাগে রয়েছে গাঢ় ধূসর বা কালো রঙের বেলে দোয়াশ মাটি- যা তরাই কালো মাটি হিসেবে পরিচিত। ভারতের জলপাইগুড়ি হতে উৎপন্ন তালমা ও কুড়ুম নদী দুটিই ছিল ভিতরগড়ে পানি সরবরাহের প্রধান উৎস।

 

ঐতিহাসিকদের মতে, ভিতরগড় পূর্ণ নির্মাণ করেন প্রাচীন কামরুনের শুদ্রবংশীয় রাজা দেবেশরের বংশজাত পৃথু রাজা। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় পৃথু রাজার অভ্যুলয় ঘটে। তিনি কামরুপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকায় গমন করেন এবং নির্মাণ করেন এই ভিতরগড়। যা পৃথু রাজার রাজধানী। স্থানীয় আধিবাসীদের নিকট তিনি মহারাজা হিসাবে পরিচিত। ১৮০৯ সালে ফ্রান্সিস বুকানন ভিতরগড় জরিপ করেন। তাঁর মতে, পৃথু রাজার রাজত্ব তৎকালীন বৈকণ্ঠপুর পরগণার অর্ধেক ও বোদা চাকলার অর্ধেক অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ছয় শতকের শেষদিকে এক পৃথুরাজা কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড়ে রাজ্য স্থাপন করেন। আবার তেরো শতকের কামরূপের ইতিহাসে এক রাজার নাম পৃথু। কেউ কেউ মনে করেন পৃথু রাজা ও রাজা তৃতীয় জল্পেশ অভিন্ন ব্যক্তি এবং আনুমানিক প্রথম শতকে তিনি ভিতরগড়ে রাজধানী স্থাপন করে এ অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন।

 

ভিতরগড়ের দুর্গনগরীতে পৃথু রাজা নির্মাণ করেন এক বিশালাকার একটি দীঘি। যার পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮শ থেকে ৪শ গজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। জলভাগের আয়তন প্রায় চারশ ও দুইশ গজ। পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। পানি অতি স্বচ্ছ। দিঘীতে রয়েছে মোট ১০টি ঘাট। নিম্নবর্ণের কিচক সম্প্রদায় দ্বারা আক্রান্ত হলে রাজা তার পবিত্রতা রক্ষার জন্য পরিবার পরিজন ও সৈন্য-সামন্তসহ দীঘির জলে প্রাণ বিসর্জন করেন।’ সেই থেকে দীঘিটির নামকরণ হয় মহারাজা দীঘি। এর ভিতরে মন্দির, প্রসাদ ও ইমারতের এবং সাবশেসে এবং বাইরে পরিখা ও মানীর প্রাচীর এখনো দেখা যায়।

 

ভিতরগড় দুর্গনগরী মূলত চারটি আবেষ্টনীর সমন্বয়ে গঠিত। এই আবেষ্টনীসমূহ একটি অপরটির ভিতরে অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনী বা প্রথম আবেষ্টনীর উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালসমূহের পরিমাপ যথাক্রমে ৩৪০ মিটার, ৬৫০ মিটার, ৬১০ মিটার ও ৪৫০ মিটার। এই দেয়ালসমূহ সম্পূর্ণরূপে ইট দ্বারা নির্মিত। দেয়ালসমূহ বর্তমানে ২.৫৫ মিটার উঁচু এবং উপরিভাগে ২ মিটার প্রশস্ত। দেয়ালসমূহ সুদৃঢ় করার নিমিত্তে বাইরের দিকে দেয়ালের সাথে আয়তাকৃতির বুরুজ সম্পৃক্ত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর উত্তর পূর্বাংশে সম্ভবত রাজবাড়ি ছিল। এই আবেষ্টনীর ভিতরে দুটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে।

 

২০০৯ ও ২০১০ সালে লেখক কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এই অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে একটি ক্রুশাকৃতির মন্দির এবং উভয় দিকে (পূর্ব ও পশ্চিম) স্তম্ভ বিশিষ্ট বারান্দা সম্বলিত পিরামিডাকৃতির একটি স্তূপ/মন্দির আবিস্কৃত হয়েছে। এছাড়াও মন্দির স্থাপত্যে ব্যবহূত বিভিন্ন নকশা খচিত ইট ও ত্রিকোনাকৃতির পাথরের খন্ড পাওয়া গেছে। স্থাপত্যের ভিত্তির নিচের স্তরে লাল ও ধূসর রঙের নকশা খচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং লোহা ও তামার তৈরী দ্রব্যাদিও পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে বেশিরভাগই হল- থালা, বাটি, রান্নার হাড়ি, তাওয়া ও মাটির প্রদ্বীপ। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে একটি কালো পাথরে তৈরি মনসা মূর্তির ভগ্নাংশ (১০.৬ × ৮.২ সেমি) পাওয়া গেছে যা বর্তমানে পঞ্চগড় মহিলা কলেজের রকস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

 

প্রথম আবেষ্টনী এবং মহারাজার দিঘিসহ পাচঁটি প্রাচীন দিঘিকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় আবেষ্টনী। প্রথম আবেষ্টনীর ন্যায় দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের বাইরেও আয়তাকৃতির বুরুজ সংযোজিত রয়েছে। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের বাইরে চতুর্দিকে ১৯ মিটার প্রশস্ত এবং ৪.৫ মিটার গভীর পরিখা রয়েছে- যার অনেকাংশেই বর্ষাকালে পানি থাকে। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, এই দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তরে কালদুয়ার এবং দক্ষিণে যমদুয়ার নামে দুটি প্রবেশদ্বার ছিল। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে পাঁচটি প্রাচীন দিঘির নাম হলো- মহারাজার দিঘি, ফুলপুকুরী, কোদালধোয়া, মলানী দিঘি এবং সিঙ্গারী দিঘি। তন্মধ্যে মহারাজার দিঘি সর্ববৃহৎ- যা ৫৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত মহারাজার দিঘির চতুর্দিক ইট ও মাটি নির্মিত ৬ মিটার উঁচু পাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। দিঘির গভীরতা প্রায় ৯ মিটার। দিঘিতে পূর্ব ও পশ্চিমে তিনটি করে এবং উত্তর ও দক্ষিণে ২টি করে মোট দশটি ইট বাঁধানো ঘাট রয়েছে। মহারাজার দিঘির পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং দিঘির ভিতরে কোনো জলজ উদ্ভিদ নেই।

 

কিভাবে যাবেন?

পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল হতে তেঁতুলিয়াগামী বাসযোগে বোর্ড অফিস নামক স্থান হয়ে রিক্সা/ভ্যান যোগে পূর্বদিকে ০৫ কিলোমিটার দূরত্বেই প্রাচীন দুর্গনগরী ভিতরগড়।

 

কোথায় থাকবেন?

পঞ্চগড় শহরে অবস্থিত আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল মৌচাক, হোটেল রাজ নগর, হিলটন বোর্ডিং, রোকখানা বোর্ডিং, হোটেল প্রীতম, হোটেল এইচকে প্যালেস, হোটেল ইসলাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সার্কিট হাউজ ও জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় যোগাযোগ করে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।

 

কোথায় খাবেন?

পঞ্চগড় শহরে হোটেল করোটিয়া, হোটেল মৌচাক, হোটেল নিরিবিলি, হোটেল হাইওয়ে ও হোটেল হামজার মতো ভাল মানের খাবার হোটেল রয়েছে।

You might like

Get the mobile app!

Our app has all your booking needs covered: Secure payment channels, easy 4-step booking process, and sleek user designs. What more could you ask for?