পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার | Paharpur Buddhist Bihar 21/01/2022


PC:


পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (Paharpur Buddhist Bihar) বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার (Sompur Mahavihara) বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার যা নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি উত্তরে অবস্থিত। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। 

 

১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হয়, এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। সারা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত জ্যামিতিক নকশার পুরাকীর্তির যে সন্ধান পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের মতে পাহাড়পুর তার মধ্যে সেরা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে এটিকে। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে।

 

চতুষ্কোনাকার পাহাড়পুর বিহারের চারদিক চওড়া সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তরে সারিবদ্ধ ৯২ টি ছোট ছোট কক্ষ ছিল। অনুমান করা হয়, বিহারটিতে সর্বমোট ১৭৭ টি ঘরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। বিহারের ঠিক মধ্যখানে শোভা বাড়িয়েছে একটি মন্দির, যার দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫০ ফুট এবং মন্দিরটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু। মন্দিরের বাইরের দেয়ালে বুদ্ধ ও হিন্দুদের দেবী মূর্তি এবং পোড়া মাটির বেশকিছু ফলক স্থান পেয়েছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মূল বেষ্টনী প্রায় ২০ ফুট চওড়া। ১৯৮৪-৮৫ সালে এখানে খননের সময় খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনামলের বিপুল রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়, যেগুলি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন জাদুঘরে রক্ষিত আছে। এছাড়াও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার হতে বেশকিছু মূর্তি, মুদ্রা এবং শিলালিপি ইত্যাদি পাওয়া যায়।

 

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে যা আছে

কেন্দ্রীয় মন্দির

বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। বিস্ময়কর মূল মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন। অসাধারণ এর শৈল্পিক পরিকল্পনা। মন্দিরের দেয়াল জুড়ে পাওয়া যায় প্রায় ২ হাজারটি অপূর্ব পোড়ামাটির ফলকচিত্র। এতে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রাচীণ বাংলার সাধারণ জনজীবনের প্রত্যাহিক প্রতিচ্ছবি। যেমনঃ মানুষ, শিকারি, নৃত্যরত রমণী, রাখাল, গাছপালা, ফুল, পশু-পাখি, হাতি, ঘোড়া আরো কত কি। চারিদেকে তাকালে চোখে পড়ে নান্দনিক শিল্প সুষমার সমাহার।

 

মূল মন্দিরটি ছিল বিহারের মাঝখানে। মূল পরিকল্পনাটির কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। এটি ধাপে ধাপে পিরামিডের মত করে উপরের দিকে উঠে গেছে। এখানে ছিল প্রদক্ষিণ পথ। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ ৩৫০ ফুট। প্রধান মন্দিরটি তৈরী করা হয়েছিল ইটের সাথে কাদা মাটি মিশিয়ে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই মন্দিরের নয়নাভিরাম গঠন শৈলী পরবর্তীতে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল বার্মা, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার জাভা আর বালি দ্বীপের বিভিন্ন বিহার নির্মাণকে। কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষে একটি ইঁট বাধানো মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ মেঝে কক্ষের বাইরে চারদিকের কক্ষ ও মন্ডপের প্রায় একই সমতলে অবস্তথিত। কিন্তু চারদিকের কক্ষগুলো থেকে কেন্দ্রীয় এ কক্ষে যাওয়ার কোন পথ বা দরজা নেই এবং আগে ছিলো, পরে বন্ধ করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। কক্ষে মূর্তি রাখার বেদী বা কুলুঙ্গী কিছুই নেই। তাই অনুমিত হয় ফাঁপা এ দন্ডটি মন্দিরের সুউচ্চ দেয়ালগুলোর সুদৃঢ় নির্মানের জন্য একটি উপকরণ ছিল। মূর্তিগুলো সম্ভবত এর চারদিকের কক্ষগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিলো। মন্দিরের শীর্ষদেশের কোন নিদর্শন নেই বিধায় এর ছাদ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কিছু বলা যায় না।

 

উন্মুক্ত অঙ্গন

বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ভোজনশালা ও রন্ধনশালা অবস্থিত। এ দুটি স্থাপনার মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি। নিবেদন স্তূপগুলোর মাঝে দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত স্তূপটি ১৬ কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির। অনুচ্চ একটি মঞ্চের মাঝে সংস্থাপিত এ স্তূপটির সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি পাকা কূপ। এ ছাড়া বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া যায় প্রশাসনিক ভবন, রান্না ঘর, ভোজন শালা, নিবেদন স্তুপ, কুয়ো ইত্যাদি।

 

স্নানাগার ও শৌচাগার

এটি মূলত বিহারের বাইরের অবস্থিত স্থাপনা। বিহারের দক্ষিণ দেয়াল হতে ২৭মি দক্ষিণে অবস্থিত একটি মঞ্চে অনেকগুলো স্নানাগার ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিলো। এটি বিহারের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাধানো পথ দ্বারা সংযুক্ত। এই পথের নিচে বিহার দেয়ালের সমান্তরালে একটি ভল্টযুক্ত খিলান রয়েছে। সম্ভবত বিহারের বহির্ভাগে অবাধে চলাচল এবং চারদিকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জন্য এইরুপ করা হয়েছিলো।

 

সন্ধ্যাবতীর ঘাট

বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে প্রাচীরের বাইরে শানবাঁধানো ঘাট আছে। এটাকে সন্ধ্যাবতীর ঘাট বলা হয়। রাজা মৈদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী এ ঘাটে নিয়মিত স্নান করতেন। বিহারের পাশ দিয়েই একটি নদী প্রবাহিত ছিল। এর দুপাশে প্রতিটি দেয়াল ১.৫মি প্রশস্ত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ঘাটটি ঢালু হয়ে প্রায় ১২মি নিচে নেমে গিয়েছে।

 

গন্ধেশ্বরী মন্দির

স্নানঘাট থেকে ১২ মি পশ্চিমে পূর্বমুখী প্রাচীরের বাইরে একটি মন্দির আছে। মন্দিরের দক্ষিন দেয়ালে বৌদ্ধদেবী পদ্মপাণির মূর্তি আছে। এটিকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় গন্ধেশ্বরীর মন্দির। এর দৈর্ঘ্য ৬.৭মি ও প্রস্থ ৩.৫মি। এর সম্মুখ দেয়ালের ইটে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের নকশা এবং গাঁথুনিতে ব্যবহৃত উপাদান দেখে মনে হয়। এতে একটি চতুষ্কোণ হলঘর রয়েছে। হলঘরের মধ্যবর্তী স্থানে অষ্টকোণাকৃতি একটি স্তম্ভের নিম্নাংশ পাওয়া যায়। পশ্চিমের উদগত একটি দেয়ালের বাইরের দিকে ১.৪মি বাহু বিশিষ্ট বর্গাকার একটি পূজার কক্ষ রয়েছে। তাছাড়া হলঘরের চারটি কুলুঙ্গিতেও মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা আছে।মন্দিরের সামনে একটি চত্বর আছে। এর মেঝে খাড়া ভাবে স্থাপিত ইট দিয়ে গাঁথা এবং গাঁথুনি পাহাড়পুরের অন্যান্য স্থাপত্য-নিদর্শন থেকে পৃথক।

 

সত্যপীরের ভিটা

সত্যপীরের ভিটা পাহাড়পুর বিহার থেকে ৩৬৫ মিটার পূর্বে অবস্থিত। এ ভিটায় একটি তারা মন্দির এবং বিভিন্ন আকার ও আয়তনের প্রচুর নিবেদন স্তূপের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। মন্দির অঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০টি পোড়ামাটির ফলক, আটহাত বিশিষ্ট দেবীমূর্তি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ লিপি খোদিত পোড়ামাটির গোল সীলগুলি থেকেই এই ভিটা ও তারা মন্দিরের অভিন্নতা প্রতিপন্ন হয়েছে। মন্দির এলাকায় ১৩২টি নিবেদন স্তূপ আছে। মন্দিরের চতুর্দিকে বিভিন্ন আকৃতির ও নকশার নিবেদন সূতপের সংখ্যাধিক্য এবং অলংকরণ এর খ্যাতি ও গুরুত্বের প্রতি সাক্ষ্য দেয়। এখানকার স্তূপগুলির মধ্যে প্রধান মন্দিরের কাছাকাছি অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত চতুষ্কোণ স্তূপটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই সূতপের প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য ৩ মি এবং বহির্ভাগের সূতপটি অলংকৃত ইট দিয়ে শোভিত। খননের ফলে এই সূতপের মধ্যস্থলে ১ মি বর্গ বিশিষ্ট একটি বাঁধানো স্মারক-কুঠুরি আবিষ্কৃত হয়েছে। কুঠুরিটি কয়েক হাজার ছোট ছোট মাটির নিবেদন সূতপের প্রতিকৃতি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। মনে হয় মন্দিরে আগত হাজার হাজার তীর্থযাত্রী তাদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীকস্বরূপ এগুলি স্মারক কুঠুরিতে উৎসর্গ করতেন।

 

প্রবেশমূল্য ও সময়যূচী

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সপ্তাহের মঙ্গল থেকে শনিবার প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৬টা এবং সোমবার দুপুর ২টা ৩০মিনিট থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত পাহাড়পুর জাদুঘর খোলা থাকে। আর অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মঙ্গল থেকে শনিবার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা এবং সোমবার দুপুর ২টা ৩০মিনিট থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। পাহাড়পুর জাদুঘরে জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা।

 

কিভাবে যাবেন?

দেশের যেকোন প্রান্ত হতে নওগাঁ শহরে এসে নওগাঁ বালুডাংগা বাস টার্মিনাল হতে সরাসরি বাসযোগে ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে যাওয়া যায়। আনুমানিক দূরত্ব আনুমানিক ৩২ কিঃমিঃ এবং বাসভাড়া- ৩০- ৪০ টাকা। অথবা দেশের যেকোন প্রান্ত হতে জয়পুরহাট শহরে এসে বাস অথবা অটোরিক্সা নিয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার চলে আসতে পারবেন। জয়পুরহাট হতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার।

 

কোথায় থাকবেন?

পাহাড়পুরে রাতে থাকা তেমন ভাল কোনও আবাসন ব্যবস্থা নেই। তবে নওগাঁ জেলায় অবস্থিত হোটেল প্লাবন, হোটেল যমুনা, হোটেল অবকাশ, মল্লিকা ইন, হোটেল ফারিয়াল ও হোটেল রাজ প্রভৃতি আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।

 

কোথায় খাবেন?

নওগাঁর গোস্তহাটির মোড়ে ভালমানের কিছু খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে।

You might like

Get the mobile app!

Our app has all your booking needs covered: Secure payment channels, easy 4-step booking process, and sleek user designs. What more could you ask for?